‘গীবত’ এর শাব্দিক অর্থ পরনিন্দা, অসাক্ষাতে অন্যের দোষত্রুটি বর্ণনা করা। ইসলামী পরিভাষায় গীবত বলা হয় কাহারও অসাক্ষাতে তাহার দোষত্রুটি (যাহা সাক্ষাতে বলিলে সে ব্যথিত হইত) বর্ণনা করা (কথা, লেখনী, বা ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে) যদিও সেই সকল দোষত্রুটি তাহার মধ্যে থাকে। আর যদি সে দোষ তাহার মধ্যে না থাকে তাহা হইলে উহাকে অপবাদ বলা হয়। উলামায়ে কিরাম বিভিন্নভাবে গীবতের যে সংজ্ঞা বর্ণনা করিয়াছেন তাহার মর্ম ইহাই। হাদীসেও এই কথাই বলা হইয়াছেঃ
আবু হুরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণিত। একদা রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলিলেনঃ গীবত কি তোমরা কি তাহা জান? তাঁহারা(সাহাবীগণ) বলিলেনঃ আল্লাহ্ ও তাঁহার রাসূলই ভাল জানেন। তিনি বলিলেনঃ তোমার ভাই সম্পর্কে এমন আলোচনা করা যাহা সে অপসন্দ করে। বলা হইলঃ আপনি এই ব্যাপারে কি মনে করেন যে, আমি যাহা বলিতেছি তাহা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে? তিনি বলিলেনঃ তুমি যাহা বলিতেছ তাহা যদি তোমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে তাহা হইলেই তুমি তাহার গীবত করিলে। আর যদি উহা তাহার মধ্যে না থাকে তবে তুমি তাহাকে অপবাদ দিলে।
তথ্যসূত্রঃ
১। মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ৬৩৫৭ ইফা,
২। আবূ দাউদ শরীফ, হাদীস নং ৪৭৯৮ ইফা
গীবতের সংজ্ঞায় ইমাম গাজ্জালী(রঃ) বলেন, গীবত বলা হয় অপরের এমন আলোচনা করা-যা সে শুনলে খারাপ মনে করে। এ আলোচনা অন্যের দৈহিক ত্রুটি, বংশগত ত্রুটি, চারিত্রিক ত্রুটি বা দোষ আলোচনা করা, ধর্ম, কর্ম, পোশাক-পরিচ্ছদ, ঘর-বাড়ী, গাড়ী-ঘোড়ার দোষ সম্পর্কিত হলেও গীবত।( তথ্যসূত্রঃ ইহইয়া উলুমুদ্দিন)
কুরআন পাক ও হাদীস শরীফে গীবতকে খুবই ঘৃণিত কাজ বলিয়া উল্লেখ করিয়া উহা হইতে বিরত থাকিবার জন্য কঠোরভাবে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। কুরআন কারীমে বলা হইয়াছে- “এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা করিও না। তোমাদিগের মধ্যে কি কেহ তাহার মৃত ভ্রাতার গোশত ভক্ষণ করিতে চাহিবে? বস্তুত তোমরা তো ইহাকে ঘৃণ্যই মনে কর”। (সূরা ৪৯ হুজুরাতঃ১২)
হাদীছ শরীফে উল্লিখিত হইয়াছেঃ আনাস ইব্ন মালিক (রাঃ) হইতে বর্ণিত। রাসূলূল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ মিরাজ রজনীতে আমাকে যখন আকাশে লইয়া যাওয়া হয় তখন (সেখানে) আমি একদল লোকের নিকট দিয়া গমন করিলাম। তাহাদের নখগুলি ছিল আগুনের। উহা দিয়া তাহারা তাহাদের মুখমন্ডল এবং পেট ক্ষত বিক্ষত করিতেছিল। আমি বলিলামঃ ইহারা কাহারা হে জিবরাঈল? জিব্রাঈল বলিলেনঃ ইহারা সেই সকল লোক যাহারা মানুষের গোশত ভক্ষণ (গীবত) করিত এবং তাহাদের সম্মান বিনষ্ট করিত।(আবূ দাউদ শরীফ, হাদীস নং ৪৮০১ ইফা)
হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, একদিন নবী করীম (সাঃ) রোযার আদেশ দিয়ে বললেন, আমি যে পর্যন্ত অনুমতি না দেই কেউ ইফতার করবে না। সাহাবায়ে কিরাম রোজা রাখলেন। সন্ধ্যা হলে এক একজন এসে ইফতারের অনুমতি নিতে লাগল। এক ব্যক্তি আরজ করল, হে আল্লাহর নবী! দুজন মহিলাও রোযা রেখেছিল, আপনি অনুমতি দিলে তারাও ইফতার করত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এভাবে সে পুনরায় একই কথা বললো এবং রাসূলও (সাঃ) মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এভাবে সে তৃতীয় বার নিবেদন করার পর তিনি বললেন, তারা রোযা রাখেনি। যারা সারাদিন মানুষের গোশত ভক্ষণ করে, তাদের আবার কিসের রোযা? তুমি গিয়ে তাদেরকে বল, তোমরা রোযা রেখে থাকলে বমি কর, সে মহিলাদ্বয়কে এ নির্দেশ শুনিয়ে দিল। তারা বমি করলে প্রত্যেকের মুখ দিয়ে জমাট রক্ত নির্গত হল। লোকটি এসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট ঘটনা বর্ণনা করলে তিনি বললেন, আল্লাহর কসম যার কব্জায় আমার প্রাণ, যদি এ জমাট মাংসপিন্ড তাদের পেটে থেকে যেত তবে তাদেরকে জাহান্নাম খেয়ে নিত। (তথ্যসূত্রঃ এহইয়া উলুমুদ্দীন)
আবূ বারযাঃ আল-আসলামী (রাঃ) হইতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ হে ঐ সকল লোক, যাহারা মুখে ঈমান আনিয়াছ অথচ অন্তরে ঈমান প্রবেশ করে নাই। তোমরা মুসলমানদের গীবত করিও না এবং তাহাদের দোষ অণ্বেষণ করিও না। কারণ যে তাহাদের দোষ অন্বেষণ করিবে আল্লাহ তাহাদের দোষ অন্বেষন করিবেন। আর আল্লাহ যাহার দোষ অন্বেষণ করিবেন তাহাকে অপদস্থ করিয়া ছাড়িবেন।(আবূ দাউদ শরীফ, হাদীস নং ৪৮০২ ইফা)।
হযরত আয়েশা (রাঃ) হইতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমি একবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলিলামঃ সাফিয়্যার এই রকম এই রকম অর্থাত খাটো হওয়া আপনার জন্য যথেষ্ট। তখন তিনি বলিলেনঃ তুমি এমন একটি কথা বলিয়াছ যদি তাহা সমুদ্রে ফেলা (সহিত মিশানো) হইত তবে অবশ্যই সমুদ্র পরিপূর্ণ হইয়া যাইত। আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ আমি তাঁহাকে একজন লোকের কথা শুনাইলাম। তিনি বলিলেনঃ আমি ইহা পছন্দ করিনা যে, আমি কোনও লোকের কথা বর্ণনা করিব আর আমার জন্য এইরূপ এইরুপ হইবে। (আবূ দাউদ শরীফ, হাদীস নং ৪৭৯৯ ইফা)।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ এক মুসলিমের উপর অন্য মুসলিমের সম্পদ, সম্মান এবং জান হারাম করা হইয়াছে। কোনও লোকের দুস্কর্ম করার জন্য ইহাই যথেষ্ট যে, সে তাহার মুসলিম ভাইকে হেয় প্রতিপন্ন করিবে (আবূ দাউদ শরীফ, হাদীস নং ৪৮০৪ ইফা)।
হযরত জাবির ও আবু সায়ীদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেন, “ গীবত করা থেকে তোমরা বেচেঁ থাক। কেননা, গীবত যেনার চেয়েও নিকৃষ্টতম।” অর্থাতঃ- যেনা করে মানুষ তওবা করলে আল্লাহ পাক তওবা কবুল করে নেন কিন্তু গীবতকারীকে মাফ করা হয় না যতক্ষণ যার গীবত করা হয় সে মাফ না করে।”
তথ্যসূত্রঃ
ক) মেরকাত শরহে মেশকাত, গীবত অধ্যায়
খ) জামেউস সাগীর, গীবত অধ্যায়
গ) কানযুল উম্মাল
বিশ্বওলী, খাজাবাবা হযরত ফরিদপুরী(কুঃ ছেঃ আঃ) ছাহেব মোহাছাবার অধ্যায়ে অধিক কথা বলার ক্ষতির আলোচনা করতে গিয়ে গীবত সম্পর্কে বলেন,
অধিক কথা বলায় বহুবিদ অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান। অধিক কথা বলার কুফল নিম্নরুপঃ-
(ক) যাহারা অধিক কথা বলে, ইচ্ছায় হউক, অনিচ্ছায় হউক, তাহার পরনিন্দা, পরচর্চা বা গীবত করিয়া থাকে।
(খ) মিথ্যা কথা বলে।
(গ) ওয়াদা ভংগ করে, কারণ ওয়াদা দেওয়ার সময় চিন্তাভাবনা না করিয়াই ওয়াদা দেয়। পরে আর রক্ষা করিতে পারে না।
(ঘ) অতিরিক্ত কথা বলার কারণে আসল কথাকে অতিরঞ্জিত করে।
(ঙ) বেহুদা কথায় লিপ্ত থাকে।
(চ) হাস্য-কৌতুকে সময় কাটায়। ফলে যিনি অধিক কথা বলেন, তাহার দেল মারা যায়। হযরত শেখ সাদী (রঃ) বলেন, “তোমার কথা আদন এর মুক্তার চেয়েও যদি মূল্যবান হয়, তথাপিও তুমি যদি বেশী কথা বল, তবে তোমার দেল মারা যাইবে। দেল অন্ধকার অচ্ছন্ন হইবে।”
অধিক কথা বলায় যে পাপ মানুষ সবচেয়ে বেশী করে তাহা হইল গীবত অর্থাত পরনিন্দা বা পরর্চচা এবং মিথ্যা কথা বলা। এইদুটোই ইসলামী দৃষ্টিকোনে জঘন্য অপরাধ বলিয়া পরিগণিত। গীবত কি? কোন ব্যক্তির অসাক্ষাতে তাহার দোষ-ত্রুটির আলোচনা করাকে গীবত বলে। রাসূলে পাক (সাঃ) বলেন, “গীবত যেনা হইতেও কঠিনতম গোনাহ।” ছাহাবাগণ আরজ করিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাঃ)! গীবত যেনা হইতেও কঠিনতর? তিনি বলিলেন “কোন ব্যক্তি যেনা করিয়া তওবা করিলে আল্লাহতায়ালা তাহার তওবা কবুল করেন এবং তাহাকে মাফ করিয়া দেন, কিন্তু গীবতকারীর জন্য তওবার কোন বিধান নাই, যে পর্যন্ত না যাহার গীবত করা হইয়াছে, সে মাফ করে।”
(তথ্যসূত্রঃ নসিহত-সকল খন্ড একত্রে, পৃষ্টা নং ৮২, নসিহত নং-৬)
কাজেই বুঝা গেল গীবত এক জঘন্য পাপ। আত্মার এক ঘৃণ্য ব্যাধি। আল্লাহপাক আমাদের দয়া করুন যেন এই জঘন্য পাপ থেকে আমরা নিজেদের হেফাযত করতে পারি। আমিন।
----আকতার হোসেন কাবুল
No comments:
Post a Comment