সম্রাট আকবরের পিতার নাম বাদশাহ হুমায়ুন। ১৫৪০ খৃষ্টাব্দে কনৌজের যুদ্ধে হুমায়ুন শেরশাহের নিকট পরাজিত হইয়া বিভিন্ন স্থানে ঘুরিয়া বেড়াইবার পর যখন অমরকোটের রানা প্রসাদের রাজ্যে আশ্রয় নেন, তখন, ১৫৪২ খৃষ্টাব্দের ২৩ শে নভেম্বর আকবর জন্ম গ্রহণ করেন।
সুদীর্ঘ পনেরো বৎসর এখানে সেখানে ঘুরিয়া বেড়াইবার পর শুর শাসকদের পারস্পপারিক অন্তদ্বন্দের সুযোগে হুমায়ুন ১৫৫৫ খৃষ্টাব্দে সেরহিন্দের নিকটে সিকান্দার শুরকে পরাজিত করিয়া লাহোর দখল করেন। সেই বছরই তিনি দিল্লী আগ্রা অধিকার করেন। ইহার অল্প কয়েকদিন পরে ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দে ২৪ শে জানুয়ারী হুমায়ুন ইন্তেকাল করেন। হুমায়ুনের ইন্তেকালের পর আকবর ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দের ১৪ই ফেব্রুয়ারী দিল্লীর সম্রাট হিসেবে ঘোষিত হন। তখন তাহার বয়স মাত্র তের বছর। ইহার পাঁচ বছর পর ১৫৬০ খৃষ্টাব্দে আকবর তদীয় ১৮ বছর বয়সে দিল্লীর শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন এবং রাজ্য পরিচালনা করিতে থাকেন।
প্রথম জীবনে সম্রাট আকবর একজন সুন্নী মুসলমান ছিলেন। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করিতেন; শরীয়তের অন্যান্য হুকুম-আহকাম যথারীতি মানিয়া চলিতেন। অনেক সময় তিনি আযান দিতেন এবং নামাজে ইমামতিও করিতেন। কিতাবে দেখা যায়, কখনও কখনও তিনি মসজিদও ঝাড়ু দিতেন। প্রতি বছর হজ্বের মওসুমে আকবর একজনকে ‘আমীর-ই-হজ্ব' নিযুক্ত করিয়া বলিতেন, “যে কেহই তাহার সহিত হজ্বে গমন করিবেন, তাঁহার সমুদয় খরচ সরকার বহন করিবে।" ইহা ছাড়াও প্রতি বছর তিনি পবিত্র কাবা ঘরের জন্য এবং উহার প্রতিবেশীদের জন্য দামী দামী উপহার প্রেরণ করিতেন।
কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন মুখী প্রভাবে প্রভাবিত হইয়া আকবর সত্য পথচ্যুত হইয়া এক অদ্ভূদ ধর্মমত প্রচার শুরূ করেন-যাহা ছিল ইসলাম পরিপন্থী ও মুসলিম স্বার্থের বিপরীত কর্মকান্ড।
ইতিহাস পর্যালোচনা করিলে দেখা যায় যে, ষোড়শ শতাব্দী ছিল সন্দেহ, সংশয় ও অনুসন্ধানের যুগ। সে যুগ ছিল ধর্মান্দোলনের যুগ; পরমত সহিঞ্চুতার যুগ। এই যুগে আবির্ভাব হয় বিশ্ব প্রেম ও ভাতৃত্ববোধ প্রচারক বিভিন্ন সাধু পুরুষের। কবির, নানক, শ্রীচৈতন্য ইহাদের মধ্যে অন্যতম। এই সমস্ত ধর্ম নেতার প্রভাব আকবরের উপর পতিত হয়। ষোড়শ শতাব্দিতে এই উপমহাদেশে মাহ্দী আন্দোলন ও রাসনী আন্দোলনও মানুষের মনকে আচ্ছন্ন করে। ‘‘মাহদী'' পন্থীদের বিশ্বাস হাজার বছরের শেষভাগে পাপ-পঙ্কিলতা হইতে মানব জাতিকে উদ্ধারের জন্য একজন মাসীহ পৃথিবীতে আবির্ভূত হইবেন। জনৈক সৈয়দ মুহাম্মদ নামক এক জৌনপুর নিবাসী এই মাহদী আন্দোলনের সূচনা করেন এবং নিজেকে সেই বিশেষ মাহ্দী বলিয়া ঘোষণা করেন। অনুরূপে আফগান স্থানে রাসনী আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়া উঠে। রাসনীগণও একজন মাসীহ বা উদ্ধার কর্তার আবির্ভাবে বিশ্বাস করিত। এই সকল আন্দোলনের অশুভ প্রভাবও আকবরের উপর পড়ে এবং তিনিও একজন ‘‘ধর্মপ্রবর্তক'' হওয়ার সংকল্প করেন।
পরে সকল ধর্মের মূল তথ্য সম্পর্কে জানিবার উদ্দেশ্যে ফতেহপুর সিক্রিতে ৯৮৩ হিজরীতে একটি ‘‘এবাদতখানা'' নির্মাণ করেন। সেখানে আমন্ত্রন করেন সকল ধর্মের মনীষীগণকে। ফলে যেমনি ইসলাম ধর্মের আলেমসকল সেখানে উপস্থিত হইতেন, তেমনি হিন্দু ধর্মের সাধু-সন্নাসীগণ, খৃষ্টান ধর্মের পাদ্রী বা ধর্মযাজকগণ, জৈন ধর্মের পন্ডিতগণও সেখানে উপস্থিত হইতেন এবং ধর্মীয় রীতি-নীতি সম্পর্কে পরস্পর আলাপ আলোচনা ও তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হইতেন। সকলের জন্য আকবরের ‘‘এবাদতখানা'' উম্মুক্ত থাকায় সেখানে ভন্ড সূফীগণ ও দুনিয়াদার আলেমগণও উপস্থিত হইয়া ধর্মালোচনায় অংশ গ্রহণ করিত।
বাদশাহ আকবর ছিলেন নিরব। তিনি পড়িতে পারিতেন না। তাই বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসী মনীষীগণের ধর্মালোচনা তিনি শুনিতে পছন্দ করিতেন। ফলে সকল ধর্মের প্রভাবই তাহার উপর পড়ে। বিভিন্ন ধর্মের নেতা বা ধর্মগুরু বা মনীষীদের প্রভাবে প্রভাবিত হইয়া, দুনিয়াদার ও অসৎ আলেমদের পরামর্শে ও প্ররোচনায় সত্য ইসলাম বিধ্বংসী, সর্ব-ধর্ম-সার সমন্বয়ে এক অদ্ভুদ ‘‘খিচুড়ী ধর্ম'' দীনে এলাহী প্রবর্তন করেন।
দীনে এলাহীর আইন প্রণয়নের জন্য আকবর চল্লিশ রত্ন নামে একটি ‘‘পরামর্শ সভা'' গঠন করে। সভার সকল সদস্যই ছিল সত্য পথচ্যূত। তাহারা আপন আপন ‘‘বিবেক ও যুক্তি-তর্কের'' মাপ কাঠিতে সব কিছুকে বিচার করিত। যাহা তাহাদের নিকট বিবেক সম্মত হইত, তাহাই দীন-ই-এলাহীর নতুন আইন হিসাবে গৃহীত হইত।
সম্রাট আকবর প্রবর্তিত দীন-ই-এলাহীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিচে তুলিয়া ধরা হইল।
দীন-ই-এলাহীর রূপরেখাঃ-
১। দীনে এলাহীর মূলমন্ত্র-‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আকবারু খালিফাতুল্লাহ।''
২। নব এই ধর্মে রাসূলে পাক (সাঃ) কে রাসূল হিসেবে স্বীকার করা রাষ্ট্রীয় বিধানে দন্ডনীয় অপরাধ বলিয়া সাব্যস্ত হয়। তদস্থানে আকবরকে ‘আল্লাহর প্রতিনিধি' স্বীকার করা রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় কর্তব্য বলিয়া নির্ধারিত হয়।
৩। নব ধর্মে ইসলামের পাঁচটি স্বম্ভকেই অস্বীকার করা হয়।
৪। নব ধর্ম অনুসারীদের তথাকথিত ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার শপথ বাণী ছিল নিম্নরূপ ‘‘আমি অমুকের পুত্র অমুক। এ যাবৎ বাব-দাদার ধর্মের অনুসারী ছিলাম। এখন স্বেচ্ছায় ও স্বজ্ঞানে তাহা পরিত্যাগ করিয়া বাদশাহ আকবরের দীনে এলাহী গ্রহণ করিতেছি এবং এই ধর্মের খাতিরে জান, মাল, ইজ্জত ও পূর্ব ধর্ম পরিত্যাগ করিতে প্রস্তুত আছি।' কাজেই নবধর্মে অনুসারীদেরকে সম্রাটের উদ্দেশ্যে চারিটি জিনিস-ধন, জীবন, ইজ্জত ও ধর্ম বিসর্জন দিতে হইত। দীন-এ-এলাহীর অনুসারীদেরকে ‘চেলা'' বলা হইত।
৫। আকবর প্রত্যেক ‘চেলা'কে নিজের ক্ষুদ্র একখানি ফটো দান করিতেন। চেলা সকল তাহা সৌভাগ্যের প্রতীক স্বরূপ আপন আপন পাগড়ীর সহিত লাগাইয়া রাখিত।
৬। নবধর্মে সূর্য পূজা, নক্ষত্র পূজা, অগ্নি, বৃক্ষ বা গরু পূজা প্রবর্তিত হয়। বাদশাহ আকবর প্রত্যহ নিজে চারবার-ভোরে, দ্বিপ্রহরে, সন্ধ্যায় ও মধ্যরাতে বাধ্যতামূলক ভাবে সূর্য পূজা করিতেন। তাহার অনুসারীবর্গ বা চেলা সকলের প্রতিও সূর্য পূজার কঠোর নির্দেশ ছিল।
৭। বাদশাহের চেহারা দর্শন না করা পর্যন্ত দীন-এ-এলাহীর অনুসারীদের দাঁত মাজা বা কোন কিছু পানাহার করা নিষিদ্ধ ছিল। ভোরের সূর্য পূজা শেষে বাদশাহ বাহিরে আসিলে, নর-নারী নির্বিশেষে সকলেই একসংগে তাহাকে সেজদা করিত।
৮। নতুন ধর্মে ‘পুনর্জন্মবাদ'' বিশ্বাস করা হয়। বাদশাহ আকবর নিজেও বিশ্বাস করিতেন যে, মৃত্যুর পর তিনি অন্য কোন স্বর্ণ সিংহাসনের অধিকারী হইয়া একই রূপ প্রভাব-প্রতিপত্তির সহিত পুনরায় আবির্ভূত হইবেন।
৯। দীন-এ-এলাহীতে মদ পান বৈধ ঘোষণা করা হয়। বাদশাহ নিজে মদ পান করিতেন ও অন্যান্যদের মদ্য পানে উদ্বুদ্ধ করিতেন।
১০। নব ধর্মমতে সুদ-জুয়া, এমনকি যেনা পর্যন্ত বৈধ ঘোষিত হয়। বাদশাহ আকবরের নির্দেশে ‘‘শয়তান পুরে'' একটি জুয়ার ঘর স্থাপিত হয় এবং জুয়ারীদেরকে রাজভান্ডার হইতে সুদে টাকা ধার দেওয়া হয়।
১১। দীনে এলাহীতে দাড়ীমুন্ডন বৈধ ঘোষণা করা হয়। পুরূষদের জন্য রেশমী কাপড় বৈধ ঘোষণা করা হয়। পর্দা প্রথা তুলিয়া নেওয়া হয়।
১২। বিবাহ সংক্রান্ত আইন প্রবর্তন করা হয়। খালাতো, ফুপাতো, মামাতো, চাচাতে বোনকে বিবাহ অবৈধ বা হারাম ঘোষণা করা হয়।
১৩। খাতনা সম্পর্কে এই নির্দেশ দেওয়া হয় যে, বার বছরের পূর্বে কোন ছেলের খাতনা দেওয়া চলিবে না।
১৪। মৃতের দাফন সম্পর্কে এই নির্দেশ দেওয়া হয় যে, দাফনের সময় এই খেয়াল অবশ্যই রাখিতে হইবে, যেন মৃতের মস্তক পূর্ব দিকে এবং পদদ্বয় পশ্চিম দিকে থাকে। মুলতঃ কাবা শরীফের অবমাননার জন্য এমন নির্দেশ প্রদান করা হয়। বাদশাহ আকবর নিজেও শয়ন কালে স্বীয় পদদ্বয়কে কেবলার দিকে রাখিয়া শয়ন করিতেন।
১৫। নব ধর্মে গরূ জবাই বা কোরবানী নিষিদ্ধ করা হয়।
১৬। গরূ মহিষ, উট, বকরীর গোশত যাহা ইসলামী দৃষ্টিকোণে হালাল তাহা হারাম ঘোষণা করা হয় এবং বাঘ, ভাল্লুক, কুকুর, বিড়ালের গোশতকে হালাল করিয়া দেওয়া হয়।
১৭। আরবী এলেম শিক্ষা করাকে রাষ্ট্রীয় বিধানে অমার্জনীয় অপরাধ রূপে সাব্যস্ত হয়। ফলে বহু আলেম-উলামা দেশ ত্যাগে বাধ্য হন। মাদ্রাসা সমূহ বিরাণ হয়। এই সুযোগে বিধর্মীরা বহু মসজিদকে মন্দিরে পরিণত করে।
১৮। নবধর্মে একাদশীর দিনে উপবাস থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। অথচ রমজানে রোজা না রাখিবার প্রতি আদেশ দেওয়া হইত। আকবর তাঁহার সভাসদদিগকে এই মর্মে নির্দেশ প্রদান করিতেন যে, তাহারা যেন মাহে রমজানে দরবারে প্রকাশ্যে পানাহার করেন। যদি তাহাদের কাহারোও পানাহারের ইচ্ছা না থাকে, তবে তিনি যেন কম পক্ষে মুখে পান পুরিয়া দরবারে আসেন। যদি এইরূপ না করা হয়, তবে তাহাকে রোজা রাখার অপরাধে পাকড়াও করা হইত।
১৯। ‘নওরোজ'' উৎসবের দিনে দরবারের আলেম-ওলামা, কাজী-মুফতী, সকলের জন্যই মদ্যপান বাধ্যতামূলক ছিল।
২০। দীনে এলাহীর অনুসারীদেরকে একে অন্যের সহিত সাক্ষাত হইলে ‘‘আস্সালামু আলাইকুম'-এর পরিবর্তে ‘‘আল্লাহু আকবর' এবং তদুত্তরে ‘‘জাল্লা জালালুহু মা আকবার শানুহু'' বলার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছিল।
২১। দীনে এলাহীর ভক্তদের এই নির্দেশ দেওয়া হয়, তাহারা যেন প্রত্যেকে নিজ নিজ চিঠিপত্রের শিরোনামে ‘আল্লাহ' নামের সাথে ‘আকবর' নামটি অবশ্যই লিখে। অন্যথায় নতুন আইনে ইহা দন্ডনীয় অপরাধ বলিয়া সাব্যস্ত হইবে।
২২। নতুন এই ধর্মে অগ্নি পূজাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। আকবর নিজে অগ্নিপূজা করিতেন এবং আবুল ফজলকে তাহার দরবারে ‘‘শিখা অনির্বাণ' প্রজ্জ্বলিত রাখিবার নির্দেশ দেন। সম্রাট আকবর দরবারে প্রদীপ জ্বালাইবার সময় দন্ডায়মান হইয়া উহার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা সভাসদদের প্রতি বাধ্যতামূলক করেন।
২৩। দীনে এলাহীতে নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত, এমনকি ঐ সমস্ত বিষয় যাহা নবুয়তের সহিত সম্পর্কিত, তাহার নাম দেওয়া হয় ‘অন্ধবিশ্বাস’’। এই সমস্ত ব্যাপারকে অবাস্তব আখ্যা দেওয়া হয়।
২৪। নব ধর্মে ইহাও বিশ্বাস করিতে হইত যে, কোরান শরীফ আল্লাহর অহী নয়; ইহা নবী করীম (সাঃ) এর রচিত গ্রন্থ।
No comments:
Post a Comment