আল্লাহর অলীদের আনুগত্য করা ফরয
بسم الله الرحمن الرحيم
আল্লাহ তা’য়ালার বাণী: واصبو نفسك مع الذين يدعون ربهم بالفد وات والعشئ الخ ا (ওয়ার্ছ্বি নাফ্সাকা মাআল্লাযীনা ইয়াদ্উ’না রাব্বাহুম বিল্গুদুওয়্যাতি ওয়াল আ’শিয়্যে) অর্থাৎ, যারা সকাল সন্ধ্যায় আপন প্রভুকে ডাকে: আপন মনপ্রাণ তাঁদের সাথে ঠেকিয়ে রাখ। অর্থাৎ যাঁরা আল্লাহকে স্মরণ করেন তাঁদের আজ্ঞা পালন কর এবং তাঁদের অনুগত হয়ে যাও। কারণ ফকির ও অলীদের আনুগত্য করা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করারই নামান্তর। এ কারণে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে: تخلقوا باخلاق الله (তাখাল্লাকু বিআখ্লাকিল্লাহ্) অর্থাৎ, “আল্লাহর চরিত্রে চরিত্রবান হও।” অলী-নবীদের চরিত্রও তাই। সুতরাং যার মধ্যে আল্লাহর চরিত্রগুণ বিদ্যমান, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি ও সম্মান প্রদর্শন করা ওয়াজিব। আর এটা অলঙ্ঘনীয় ওয়াজিব। এটা ফরজের স্থলে শর্তসাপেক্ষ ওয়াজিব নয় যে, শর্ত অপসারিত হলে ওয়াজিবও অপসারিত হয়ে যাবে। উদাহরণস্বরূপ যাকাত প্রদান ওয়াজিব, কিন্তু যাকাত আদায় করার পর তা আর ওয়াজিব থাকে না। অপরদিকে অলীদের আনুগত্য করা মৌলিক এবং অলঙ্ঘনীয় ওয়াজিব, ফরজের চেয়েও অধিক গুরুত্ববহ। কারণ এরূপ স্থায়ী ওয়াজিব থেকেই ফরয ও অন্যান্য হুকুম-আহ্কাম বের হয়। কারণ সার্বক্ষণিক ওয়াজিব কখনো অপসারিত হয় না। যেমন আল্লাহ-রাসূল এবং অলীদের প্রতি বিশ্বাস রাখা ওয়াজিব, আর কিয়ামত পর্যন্তই এটা ওয়াজিব। এমনিভাবে প্রমাণিত মৌলিক ওয়াজিবসমূহ পালন করাও সার্বক্ষণিক ওয়াজিব।
মোটকথা, ফকির-অলীদের আনুগত্য করা ওয়াজিব। তাঁদের কোনো কাজ শরিয়ত বিরোধী মনে হলেও তা কেবল বাহ্যিক, কিন্তু অন্তর্নিহিত শরিয়ত বা আল্লাহ তা’য়ালার বিরোধী নয়। আহলে জাহেরগণ বাহ্যিক শরিয়তের ওপর নির্ভরশীল। অথচ দৃশ্যত যা বৈধ ও ভালো মনে হয়, প্রকৃতপক্ষে তা বিপরীতও হয়। উদাহরণস্বরূপ, রক্ত এবং মণি প্রভৃতি বাহ্যতঃ অপবিত্র। কিন্তু অন্তঃসারের বিচারে পবিত্র। কারণ উহা দ্বারা পবিত্র মানুষ সৃষ্টি হয়। অনুরূপ যে কোনো অবস্থাতেই স্ত্রী সঙ্গম বৈধ এবং কারও কাছে বললে গালির মতো শোনায়। আল্লাহর অলীদের কাজকেও এভাবেই বিচার করতে হবে।
হযরত খিজির (আঃ)-এর ঘটনা গভীরভাবে চিন্তা করুন। সংক্ষেপে তা হল এই যে, হযরত খিজির (আঃ) সতর্কতামূলকভাবে হযরত মূসা (আঃ)-কে অঙ্গীকার করিয়ে নিয়েছিলেন যে, আমার কোনো কাজে আপনি আপত্তি করবেন না। যদি করেন তাহলে আমার থেকে আলাদা হয়ে যাবেন। হযরত মূসা (আঃ) বললেন, ইনশা আল্লাহ আমি অবশ্যই এ কথায় বহাল থাকব। অতঃপর হযরত খিজির (আঃ) নদীর তীরে গেলেন। সেখান থেকে মালিকের অনুমতি ছাড়াই একটি নৌকা নিয়ে নদী পার হলেন এবং পরে স্বীয় লাঠির আঘাতে নৌকাটি ভেঙে নদীতে ডুবিয়ে দিলেন। হযরত মূসা (আঃ) দেখলেন এটা সম্পূর্ণ শরিয়তবিরোধী কাজ। কারণ মালিকের অনুমতি ছাড়া কোনো জিনিস নেওয়া অবৈধ। তদুপরি উহা ভেঙে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে এবং অদৃশ্য করে ফেলা হয়েছে। একই ঘটনায় তিন চারটি নিষিদ্ধ কর্ম বা হারাম কাজ হল, তাই হযরত মূসা (আঃ) আপত্তি উত্থাপন করলেন যে, আপনি এসব শরিয়তবিরোধী কাজ করেছেন। তখন হযরত খিজির (আঃ) বললেন, আমার কাছ থেকে আপনি এখনি বিদায় হোন। হযরত মূসা (আঃ) বিনীতভাবে অপরাধ ক্ষমা চাইলেন এবং কথা দিলেন, আর এমন হবে না। অতঃপর সেখান থেকে এগিয়ে পথে একটি ছেলেকে স্বীয় লাঠির আঘাতে খিজির (আঃ) মেরে ফেললেন। হযরত মূসা (আঃ) আবারও এতে আপত্তি করেন। নূরানী বক্ষ হযরত খিজির (আঃ) রেগে গিয়ে বললেন, আপনি আমার থেকে বিদায় হোন। হযরত মূসা (আঃ) আবারও ক্ষমাপ্রার্থী হলেন। হযরত খিজির (আঃ) তাঁকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। পথে একটি ভাঙা দেয়াল পেয়ে দিনব্যাপী মেরামত করে দিলেন। এ কাজ কেউ তাঁকে করতেও বলেনি বা এজন্য তিনি কোনো পারিশ্রমিকও পাননি। একান্ত স্বেচ্ছায় কাজটি করেছেন। মূসা (আঃ) আবার প্রতিবাদ করলেন, নূরানী বক্ষ হযরত খিজির (আঃ) তাঁকে আলাদা হতে বললেন, এবার আপনার বিদায়ের পালা। কারণ আমার কাজ আপনার অপছন্দ এবং আপনি গোপন জ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞ। প্রকৃতপক্ষে জাগতিক নবীর ধৈর্যও নেই। তখন হযরত মূসা (আঃ) আরজ করলেন, আপনি নৌকা ভাঙলেন, এর রহস্য কী? উত্তর দিলেন, জনৈক জালিম বাদশা আসছিল, সে নৌকার মাঝি-মাল্লা সকলকে ধরে নিয়ে যেত। তাই এটাকে ডুবিয়ে দিয়েছি যেন বেচারার নৌকা নিজেই পেয়ে যায় এবং এ নৌকা দ্বারা ঐ গরিবরা তাদের জীবিকা অর্জন করতে পারে। নাবালকটাকে হত্যা করার রহস্য হল ছেলেটা ডাকাত হত, তার পিতা-মাতাকে কষ্ট দিত এবং আল্লাহর অবাধ্য হত। এজন্য আমি তাকে হত্যা করেছি। অতঃপর তার আর একটি ভগ্নি জন্মগ্রহণ করবে এবং তার আওলাদদের মধ্যে সত্তর জন নবী জন্ম নিবেন। আর দেয়াল মেরামতের মাধ্যমে আমি জনৈক অনাথকে সাহায্য করেছি। এ দেয়ালের নিচে তার পিতার অনেক সম্পদ লুকায়িত আছে। এ দেয়ালটি পড়ে গেলে সে সম্পদ অন্যে নিয়ে যেত। আক্ষেপ এ সব বিষয়ে আপনি মোটেই অবহিত নন এবং আপনার কোনো অদৃশ্য জ্ঞানও নেই। আপনি যদি আমার কাজে আপত্তি উত্থাপন না করতেন, তাহলে অনুরূপ হাজারও বিষয়ে আপনাকে শিক্ষা দিতাম। এখানে চিন্তার বিষয় এই যে, হযরত মূসা (আঃ) নবী হয়েও নিজের ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন এবং আপত্তি উত্থাপন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা’য়ালা গোপন জ্ঞান শিক্ষার জন্য নূরানী বক্ষ হযরত খিজির (আঃ)-এর নিকট তাঁকে প্রেরণ করেছিলেন। এতদসত্ত্বেও তিনি বাহ্যিক শরিয়তের অনুসরণ করেন এবং নূরানী বক্ষ হযরত খিজির (আঃ)-এর কার্যাদি খারাপ ও দোষণীয় মনে করেন। তিনি এটা চিন্তাই করেননি যে, যেহেতু আল্লাহ আমাকে তাঁর কাছে পাঠিয়েছেন, সেহেতু তাঁর তাক্লীদ বা অনুসরণ করা আমার কর্তব্য এবং তাঁর সাথে বিরোধ করা অনুচিত। এজন্যই ফকির এবং অলীদের কোনো কাজ শরিয়তের ঘোর বিরোধী মনে হলেও, তাঁদের আনুগত্য করতে হবে। কারণ অলীদের হাত আল্লাহর হাতে স্থাপিত। আল্লাহ যা করান তা-ই তাঁরা করেন, যদিও দৃশ্যত তা আপত্তিকর মনে হয়। যেমন কোনো অলী দেখলেন যে কোনো ব্যক্তির ওপর অদৃশ্য বিপদ আসছে, তখন তিনি তার কিছু মালামাল তার অনুমতি ছাড়াই সরিয়ে নিলেন এবং যতদিন না তার বিপদ কেটে যায়, ততদিন তা নিজের কাছে রেখে দিলেন। এটা চুরি হবে না, বরং এটা হবে মালের মালিকের প্রতি দয়া প্রদর্শন। কারণ সে সময় সে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছিল। তার মালের কিছু অংশ অলী নেওয়ার বদৌলতে আল্লাহ তা নিরাপদে রেখেছেন। এভাবে আল্লাহর অনেক অলী সময় সময় দৃশ্যত শরিয়তবিরোধী বহু অপ্রয়োজনীয় কাজও করে থাকেন। কখনো লোকদের গালি দেন। এ গালিরও অর্থ আছে। সময় বিশেষে কাউকে লক্ষ করে গালি দিলেও আসলে বিপদ-আপদকেই গালি দেওয়া হয়। উদ্দেশ, যাতে তার বিপদ-আপদ দূর হয়ে যায়। লক্ষণীয়, যে ভালো করতে চাচ্ছে, আমরা তাঁর দুর্নাম করছি। হযরত খিজির (আঃ) নৌকা ডুবিয়ে দিয়েছেন, নৌকার মালিক দেখলে অবশ্যই তাঁকে চোর মনে করত। অনুরূপভাবে কোনো কোনো ফকির পতিতার ঘরে যাতায়াত করেন. কখনো কখনো মন্দিরেও যান। এতেও রহস্য আছে। এতে চতুর্দিকে প্রসারিত মূর্তির প্রভাব দমন হচ্ছে, অথবা অন্য রহস্যও আছে। আল্লাহর কোনো কোনো অলী নেংটি পরিধান করেন, এরও তাৎপর্য আছে। বিশেষত এর দ্বারা তাঁরা নিজের নফ্সকে লাঞ্ছিত করেন এবং এ লাঞ্ছনার বিনিময়ে অজস্র রহমত ও নেয়ামত লাভ হয়। স্মরণীয় যে, নেংটি পরিধান করা তথা গুপ্তাঙ্গ ঢাকা মালিকী মাজহাবে ফরজ। অথচ অলীদের মাজহাবে তো ফরজই নেই। কারণ তাওহীদপন্থী যখন তাওহীদের সাগরে নিমজ্জিত হতে থাকেন, তখন বাহ্যিক শরিয়তের কোনো তোয়াক্কা থাকে না। ‘আওয়ারিফ’ এবং ‘ফচুছ্’ প্রভৃতি তাসাউফের কিতাব দ্রষ্টব্য। তবে আল্লাহর অলীগণ সব সময়ই মঙ্গল করে থাকেন। তাঁরা যেখানে থাকেন সেখানে আল্লাহর রহমত অবতীর্ণ হয়। হাদীস শরীফে আছে যে, আল্লাহর অলীগণ পানাহার ও কথা বলার সময় রহমত নাযিল হয়। অতএব তাঁদের সব কথাই রহমত মিশ্রিত। তাঁরা যদি কাউকে মারেনও তাও রহমত।
অলী দু প্রকার: মুতাসাওফিয়া এবং মালামাতিয়া। মুতাসাওফিয়াগণ কদাচিৎ ছাড়া কখনো বাহ্যিক শরিয়তের খেলাফ কিছু করেন না। কিন্তু মালামাতিয়াগণ দৃশ্যত শরিয়তের খেলাফ করেন। যেমন: নেংটি পরা অথবা উলঙ্গ থাকা ইত্যাদি। তবে অধিকাংশ গাউস-কুতুব-আবদাল এবং উত্তম ব্যক্তিত্ব এদের থেকেই আবির্ভূত হন এবং এরাই পৃথিবীর হিতাকাক্সক্ষী।
আলমের বিবরণ
আলম একটি সুমহান স্থান। যাকে আলম-এ-মুতলাক বলা হয়। কোনো কোনো হিসেবে আলম দু’ভাগে বিভক্ত। যেমন: আলম-এ-আমর এবং আলম-এ-খাল্ক। আবার কোনো হিসেবে আলম চার ভাগে বিভক্ত। যেমন: ১। নাসুত ২। মালাকুত ৩। যাবারুত ৪। লাহুত। অন্য হিসেবে আলম সাতটি: ৫। হাহুত ৬। ইয়াহুত ৭। বাহুত। আর কোনো হিসেবে নয়টি: ৮। আহুত এবং ৯। হামিদা। আবার কোনো হিসেবে আঠারোটি। মোটকথা আলম-এ-মুতলাক-এর উৎসের প্রেক্ষিতে নামের পার্থক্য হয়েছে। অর্থাৎ আলম-এ-জাত অর্থাৎ আলম-এ-লাহুতের পরবর্তী স্তরসমূহ নিম্নক্রমে পরস্পর শাখা বিশেষ এবং উপরের আলম তথা হাকীকত-এ-জাত ঊর্ধ্বানুক্রমে একে অন্যের উৎস। কিন্তু এ জাতের শেষ নেই। এর পরিপূর্ণ আলোচনা সম্ভব নয়। তাছাড়া এ জাতে যা কিছু রয়েছে, তা জানা এবং দেখা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তবে যে নিজেকে জানতে পারে এবং দেখতে পায় তার পক্ষে সব কিছু জানা ও দেখা সম্ভব। কারণ সমগ্র বিশ্ব স্বীয় অজুদের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ অজুদ সমগ্র জগৎই অজুদ। আর জগতের মধ্যে অজুদই জগৎ। উদাহরণস্বরূপ প্রত্যেকটি স্ফুলিঙ্গে আগুন অন্বেষণ করে, সে তো আগুনের সাথে স্ফুলিঙ্গ এবং স্ফুলিঙ্গের সাথে আগুনও পেয়ে থাকে। অনুরূপভাবে অজুদ এবং জগৎ একটাই। অজুদের বিচারে জগৎও অজুদ। আর অজুদকে জগতের প্রেক্ষিতে বিচার করলে অজুদও জগৎ। এটা যে জানে না, এমন লোকদের নিকট এসব কথা বলা না বলা সমান।
জগতের রূপ
জগৎ একটি হেকমতময় বীজ। এর মধ্যে ফল, ফুল, বৃক্ষ, মগজ ও তৈল সবই বর্তমান এমনকি তা আঠারো হাজার সৃষ্টির জন্ম-পরিসর। যেমন: একটা খোসার মধ্যে শত শত দানা আছে এবং প্রত্যেকটি দানার জন্য পৃথক পৃথক স্থান নির্ধারিত রয়েছে, আবার সে সবগুলো দানা রয়েছে একটি মাত্র সাধারণ স্থানে। অতএব এরা সব মিলে এক আবার একই সব। মৌলিক এবং অমৌলিক, এ প্রেক্ষিতে একের বহু হওয়া এবং বহু-এর এক হওয়া, একে অন্যের পরিপূরক এবং দৃশ্য জগতের মূল হল, আলম-এ-জাত তথা লাহুত। আবার আলম-এ-লাহুত এর মূলকে বলা হয় আলম-এ-হাহুত। অনুরূপভাবে আলম-এ-সিফাত অর্থাৎ, আলম-এ-যাবারুত এবং মালাকুত প্রভৃতিও মূলের শাখা-প্রশাখা মাত্র। অতএব, যা কিছু জগৎ মাঝে বিদ্যমান, তা সবই মানুষের মধ্যে বর্তমান। এ জন্যই হাদিস শরীফে বলা হয়েছে, “যে নিজেকে চিনেছে, সে তার প্রভুকেও চিনেছে।” কবর আযাব কথাটিরও এ একই অর্থ। অর্থাৎ কবরের বড় বড় সাপ বিচ্ছু প্রভৃতি সবই স্বীয় দেহের প্রজাতি। অর্থাৎ, স্বীয় দেহে বর্তমান বিষ থেকে বিভিন্ন ধরনের দংশনকারী জীব জন্মিবে এবং তাকে দংশন করবে। মানুষের পেটে যেভাবে কৃমি জন্মগ্রহণ করে, সেভাবে মৃত দেহে নিজে নিজেই অনেক ধরনের পোকার জন্ম হয়। শাস্তি ও শান্তি উভয়ই স্বীয় অজুদ অর্থাৎ সত্তা তথা রুহানী সত্তা জাত। এ সময় তাদের মধ্যে রুহ্ প্রবিষ্ট করানো হলে ঐসব পোকার কারণে তাদের কষ্ট হবে। এ পোকা, সাপ, বিচ্ছু যা কিছুই হবে তা সৃষ্টির বাইরে নয়। ভালো হোক আর মন্দ হোক বীজ এটাই। যেমন, মানুষ যখন শয়তানি করে, তখন তাকে শয়তান বলা হয়। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে শয়তানি এবং কুকুরের স্বভাব দেখা গেলেই তাকে শয়তান বা কুকুর ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করা হয়। এ কারণে হাশরের দিন অনেক লোক বানর ও শূকর প্রভৃতির আকৃতিতে কবর থেকে উত্থিত হবে। এর অর্থ হল, বহু আকৃতি-প্রকৃতির বীজ মানুষের স্ব-স্ব অজুদে তথা সত্তায় বর্তমান। উদাহরণস্বরূপ মাটি থেকে বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ, বৃক্ষরাজি এবং জঙ্গল প্রভৃতি জন্মলাভ করে। মাটির সাথে সকল জিনিস ও প্রজাতির বীজ হিক্মত তথা বিজ্ঞানসম্মতভাবে একসঙ্গে মিশিয়ে উহাকে আটার রুটির মতো তৈরি করা হয়েছে। এ কারণে ভূমি সৃষ্টি করে কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত উহাতে বৃষ্টিপাত করা হয়। অতঃপর কয়েক হাজার বছর ধরে উহাকে শুকানো হয়। এভাবে বার বার এরকম করা হয়, ফলে সব জিনিসের বীজ পরিপক্ব হয়ে মাটির সাথে মিশে যায় এবং উহাতে শক্তি সঞ্চিত হতে থাকে। পানি থেকে পর্যায়ক্রমে ভূমির উৎপত্তি হয়েছে: কথাটির অর্থ ভিন্ন। এ কারণেই ভূ-পৃষ্ঠে নানা রকম বৃক্ষাদি, পাথর, রকমারি উদ্ভিদ এবং নানা শ্রেণীর জীবজন্তু জন্মগ্রহণ করেছে। প্রত্যেকদিন আল্লাহ তা’য়ালা এগুলোকে সৃষ্টি করছেন না। তবে আল্লাহ তা’য়ালা কোনো প্রজাতি থেকেই দূরে নন বা বিচ্ছিন্ন নন। কেউ কেউ লিখেছেন যে, জ্ঞানের প্রেক্ষিতে আল্লাহ সকল বস্তুর সন্নিকটে। এর অর্থ হল, তিনি সত্তাগত জ্ঞানসূত্রে এসবের কাছাকাছি। কারণ সমস্ত বস্তুতেই অবশ্যম্ভাবীরূপে পরমসত্তা ব্যাপ্ত এবং এ সত্তার সাথে জ্ঞানও রয়েছে। এ বিষয়ে অজ্ঞ ব্যক্তির কিছু লেখা না লেখা সমান।
সুতরাং ভূমিকে হেয় জ্ঞান করা কারও উচিত নয়। কারণ ভূমির উপাদান অনেক উচ্চতর মর্যাদাসম্পন্ন এবং মৌলিক নূর ও সিজ্দার নূর দ্বারা ভূমি সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই গোটা ভূ-বিশ্বকেই আল্লাহ মসজিদ আখ্যা দিয়েছেন। এখানে স্বর্ণ-রৌপ্য-নবী-অলী এবং বিভিন্ন রকমের মূল্যবান প্রস্তরাদি জন্মে। এসব বিষয়ে পরিপূর্ণতার ক্ষেত্রে মাটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। শুধু দু একটি কারণেই নয়: সব দিক থেকেই মাটিকে আল্লাহ পছন্দ করেছেন। পবিত্র জগতের সাথে মাটির কী সম্পর্ক: এটা যারা বলেন, তারা যদি এখানে মাটি দ্বারা ধুলোবালি এবং আবর্জনা বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে ঠিক আছে। অন্য কিছু বুঝিয়ে থাকলে তা ঠিক নয়। কারণ আল্লাহ তা’য়ালা মাটি থেকেই তাঁর বন্ধুদের সৃষ্টি করেছেন এবং এতে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পবিত্র নূর যুক্ত রয়েছে। এ মাটি সকল মাটির মানুষের কাছে মাতৃতুল্য পবিত্র। সুতরাং মাটিকে ভালোবাস এবং নিজেকে মাটির মতো করে গড়ে তোলো। তাহলে আল্লাহ তোমাদের পছন্দ করবেন।
No comments:
Post a Comment